ঘাতক ত্রিকোণ

ঘাতক ত্রিকোণ
-প্রলয় কুমার নাথ

 

 

(১)


গোয়েন্দা গৈরিক সেনের বাজারটা এখন খুব একটা ভালো চলছে না। ইতিপূর্বে কলকাতার বেশ কিছু রহস্যময় খুনের কেসের সমাধান করায় তার পুলিশ মহলে বেশ নাম ডাক হয়েছে, এই কথা ঠিক, কিন্তু ইদানিং কালে তেমন কোনো পছন্দসই কেস তার হাতে জুটছে না। অবশ্য কিছু ছোট খাটো চুরি ছিনতাই-এর কেস ইতিমধ্যেই তার কাছে এসেছিলো, কিন্তু সে নিজেই সেগুলিতে মাথা ঘামাতে অস্বীকার করেছে। তাই রাসবিহারী মোড়ের একটি বহুতলীতে অবস্থিত তার “সেন’স আই” নামক অফিস ঘরটা হয়ে উঠেছে বন্ধু বান্ধবদের সাথে গল্প-গুজব করার আখড়া। বলাই বাহুল্য, তার মধ্যমণি হয়ে বিরাজমান গৈরিকের একমাত্র এসিস্ট্যান্ট তথা আদরের খুড়তুতো বোন, ঐন্দ্রিলা সেন, ওরফে টুসু।

এমনিই একটি শীতের সন্ধ্যা বেলায় টুসু এবং তার বান্ধবীরা গৈরিকের সাথে মেতেছিলো আড্ডায়। টুসুর বান্ধবীদের গৈরিকের প্রতি অপার কৌতূহল, তবে সেটা তার গোয়েন্দাগিরির থেকেও বেশি তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি। তার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা, সে বিয়ে কবে করবে…এই ধরণের নানা প্রশ্নবাণে মাঝে মাঝেই জর্জরিত হয়ে ওঠেন আমাদের গোয়েন্দা মশাইটি। আর তা হবেই বা না কেন, অমন ধনী পরিবারের একমাত্র সুদর্শন ছেলে, তাও আবার প্রসিদ্ধ গোয়েন্দা… এমন বঙ্গসন্তানের অবিবাহিত থাকাটাই খুব বিস্ময়কর। টুসুর এমন বান্ধবীরাও আছে, যারা ক্রমাগত তাকে বলে চলেছে গৈরিকের সাথে তাদের একটা ‘সেটিং’ করিয়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু টুসু জানে যে তার জেঠতুতো দাদাটি এই সবে ফাঁসবার পাত্র নয়। সে এড়িয়েই চলে এমন আবদারগুলিকে।

বেশ কিছুক্ষন আগে সুইগির ছেলেটা সকলের জন্য পিৎজা দিয়ে গেল। আর তার সাথে সকলের জন্য ধূমায়িত কফির কাপও রেখে গিয়েছে এই অফিসের একমাত্র চাকর রঘুদা। ওরা মহা আনন্দে তা সাবাড় করে ফেলেছে প্রায়, এমন সময় আবার হন্তদন্ত হয়ে অফিসঘরে প্রবেশ করলো রঘুদা। তার হাবভাব দেখেই তার কিছু বলার আগে বলে উঠলো গৈরিক, “কেউ আমার সাথে দেখা করতে এসেছে তো? যাও, পাঠিয়ে দাও…”
রঘুদা চলে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই ঘরের প্রবেশ করলো বছর বাইশ তেইশের এক তরুণ। বেশভুষা এবং মাথায় চুল যথেষ্ট এলোমেলো, দেখেই মনে হচ্ছে কি যেন এক অস্থিরতা দানা বেঁধেছে তার মনে।

সে এসে সকলকে নমস্কার জানানোর সাথে সাথেই টুসুর বান্ধবীরা বুঝে গেল, যে এখন এই ঘরে হাসি মজাক না হয়ে নিশ্চয় কোনো জরুরি কথাবার্তা চলবে। তাই তারা সকলে একে একে বিদায় নিলো। তারা চলে গেলে, ছেলেটি বেশ চিন্তিত কণ্ঠে গৈরিককে বলে উঠলো, “নমস্কার গৈরিক বাবু, আমি শশাঙ্ক…শশাঙ্ক মুখার্জি। সিটি কলেজের বি.এস.সি থার্ড ইয়ারের ছাত্র। আসলে, আমি জানি না আপনাকে কোনো পারিশ্রমিক দেওয়ার সামর্থ আমার আছে কিনা….”
“আরে দাঁড়ান মশাই”, হাস্যকৌতুক স্বরে বলে উঠলো গৈরিক, “এখনো তো আপনার সমস্যার কথাটাই শোনা হল না, এরই মধ্যে পারিশ্রমিকে চলে গেলেন!”
শশাঙ্ক যেন একটু অপ্রস্তুত হল এই কথাই, তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “মিস্টার সেন, আমার সমস্যাটা আমাকে নিয়ে নয়। আমার গার্লফ্রেন্ড শ্রীপর্ণাকে নিয়ে। ও আমার সাথে একই ক্লাসে পড়ে। ফিজিওলজি অনার্স…একটি আত্মহত্যার প্ররোচনার কেসে আজ সকালেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাকে!”

টুসু বললো, “স্ট্রেঞ্জ, পুলিশ কেন এমন করতে গেল! আপনি আমাদের সব কিছু খুলে বলুন, মিস্টার মুখার্জি!”
শশাঙ্ক ম্লান মুখে বলে উঠলো, “কিছুদিন আগে খবরের কাগজে এই বিষয়টা নিশ্চয় পড়েছিলেন আপনারা, যে সিটি কলেজের এক অধ্যাপক, ডাঃ অরূপ মজুমদারের বিরুধ্যে রেপ এটেম্পট-এর অভিযোগ এনেছেন সেই কলেজেরই এক ছাত্রী….”
মৃদু হেসে গৈরিক বলল, “হ্যাঁ পড়েছি। আর নিশ্চয় সেই মেয়েটিই হল আপনার গার্লফ্রেন্ড শ্রীপর্ণা, রাইট?”
“হ্যাঁ, মিস্টার সেন, শ্রীপর্ণাই হল সেই মেয়ে…গত দুই দিন লো-প্রেসার নিয়ে কলকাতার একটি নামী হাসপাতালে ভর্তি হন ডা: মজুমদার। সেখানে গিয়ে ধরা পড়ে, যে তার দুটি কিডনিই ফেল করেছে। তার হৃদ-স্পন্দনের গতিও হয়ে ওঠে অনিয়মিত। গতকাল দুপুরেই সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ডা: মজুমদার!”

কিছুক্ষন থেমে নিজেকে একটু ধাতস্ত করে নিলো শশাঙ্ক, তার পর আবার বলতে শুরু করলো, “আসলে ওই রেপ এটেম্পট-এর কেসে অরূপ বাবুর সত্যিই কোনো দোষ ছিলো না, গৈরিক বাবু। আমি মানছি, সব দোষ ছিলো শ্রীপর্ণার। সে প্রথমে ভেবেছিলো যে সেদিন কলেজের শেষে স্যারের চেম্বারে একা গিয়ে, তাকে হালকা সিডিউস করলেই আসন্ন টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতাতে পারবে! কিন্তু স্যার যখন তার এই আচরণে একটুও গললেন না, তখন ও রাগের মাথায় চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, কলেজে সেই সময় সকলকে ডেকে বলে, যে স্যারই তাকে নিজের চেম্বারে একা ডেকে এনে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন! তার কথা সকলে বিশ্বাসও করে, এবং স্যারকে কলেজ থেকে কিছুদিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। তিনি হতাশায় ভেঙে পড়েন।”

ঘৃণায় মুখ সংকুচিত করে বলে উঠলো টুসু, “বাহ, আশা করি আপনি নিজেই বুঝতে পেরেছেন আপনার প্রেমিকার চরিত্রের কথা! এমন অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে অধ্যাপক পদে কর্মরত কোনো সম্মানীয় পুরুষের পক্ষে আত্মহত্যা করা খুব স্বাভাবিক, এবং তা হলে শ্রীপর্ণার উপযুক্ত শাস্তিও পাওয়া উচিত! কিন্তু তিনি আত্মহত্যা করলেন কিভাবে?”
“অরূপ স্যারের হাই ব্লাড-প্রেসারের সমস্যা ছিল। তিনি তার জন্য একটি ওষুধ খেতেন, যার প্রধান উপাদান হল ‘Amlodipine’. পুলিশের বক্তব্য, যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের রাতে, তিনি এই ওষুধের সাথেই ‘Clarithromycin’ নামক একটি এন্টি-বায়োটিক খুব বেশি মাত্রায় খেয়েছিলেন। এবং তার এই নিদারুণ পরিণতি হল এই দুটি ড্রাগের এক সাথে কাজ করে সৃষ্টি করা বিষক্রিয়ার ফল! কলেজ থেকে সাসপেন্ড হয়ে, হতাশায় ভেঙে পড়ে তিনিই নিয়েছেন এই ভাবে নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত, কারণ ফিজিওলজির অধ্যাপক হওয়ায়, তার কাছে এই দুটি ড্রাগের সমবেত বিষক্রিয়ার কথা অজানা নয়।”

এতক্ষন পর মুখ খুললো গৈরিক, “তাহলে তো বলতে হবে, যে উচিৎ শাস্তি হয়েছে আপনার বান্ধবীর। তা আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারবো বলুন?”
“আমি মানছি, গৈরিক বাবু, যে শ্রীপর্ণা সেদিন ঝোঁকের মাথায় একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছিলো। বেশ কিছুদিন ধরে ওর বাবা হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থায় পড়ে ছিলেন, পড়াশোনা কিছুই হয়নি সেই সময়। তাই হয়তো….কিন্ত, তারপর সে নিজেই অরূপ স্যারের কাছে ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সকলের সামনে নিজে মুখে নিজের পাপের কথা প্রকাশ করার কথা বলে। স্যার তাকে ক্ষমাও করে দেন। তাই আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবো না, যে স্যার এরপরেও হতাশায় ভেঙে পড়ে এমন পদক্ষেপ নেবেন…আমার মনে হয়, যে অরূপ স্যারের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে, গৈরিক বাবু! সেটাই খুঁজে বার করতে হবে আপনাকে! আর বাঁচাতে হবে শ্রীপর্ণাকে!”

গৈরিক এরপর কোনো কথা বললো না, শুধু কুঁচকে উঠলো তার প্রশস্ত কপালের চামড়া! অনেক দিন পর, আবার উত্তেজনায় বুক কেঁপে উঠলো টুসুর…তার মানে আবার সত্যিই কোনো রোমহর্ষক কেস এসে হাজির হল তার গেরোদার সামনে!

(২)


বেহালার পর্ণশ্রীতে হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি অরূপ বাবুর। বাড়িটার সামনে বেশ বড় একটি লোহার গেট, তা দিয়ে ঢুকতেই নাম না জানা নানা ফুলগাছের সমাহার। বাড়িটার পেছন দিকে ও দুই পাশে বেশ বড় বাগান, তাতে ভর্তি আম, নারকেল, পেঁপে, কাঁঠাল, সজনে প্রভৃতি নানা গাছের সারি। গৈরিক আর টুসু বসে ছিলো এই বাড়ির এক তলার বৈঠকখানার একটি ঘরে। অরূপ বাবুর সংসারে আছেন শুধুমাত্র তার স্ত্রী উর্মি দেবী। মাত্র দুই বছর আগে তাদের বিবাহ হয়। সত্যিই অসাধারণ সুন্দরী এই উর্মি দেবী, যদিও বা আজ তার চেহারায় সদ্য স্বামীকে হারানোর শোক খুব স্পষ্ট।

নিজেদের পরিচয় দেওয়ার পর, গৈরিক সরাসরি প্রশ্ন করে উঠলো উর্মি দেবীকে, “আপনার কি মনে হয়, কলেজের ওই ঘটনাটির জন্যই কি এই ভাবে নিজেকে শেষ করে দিলেন আপনার স্বামী?”
“সঠিক ভাবে বলতে পারবো না”, সজল চোখে গৈরিকের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন উর্মি দেবী, “তবে তিনি খুব ভেঙে পড়েছিলেন ওই ঘটনার পর। শুধুমাত্র একটা প্রশ্নপত্রের লোভে, একটা নির্দোষ মানুষকে এই ভাবে ফাঁসানো…ছি!…ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে আমার! সমগ্র নারী জাতির কলঙ্ক ওই মেয়েটা….”, উত্তেজিত কণ্ঠে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি, “আমার কপালটাই খারাপ জানেন…সেই কোন চোদ্দ বছর বয়সে বাবাকে হারালাম। মা বিয়ে করলেন এমন একজনকে, যার চোখে পিতৃসুলভ স্নেহের চেয়ে নিজের ছোট্ট শরীরটার জন্য যৌনতায় ভরা লোভই বেশি দেখেছি। বাধ্য হয়েই মা আমাকে ভর্তি করে দেন বোর্ডিং স্কুলে!…আর এখন, স্বামীকেও হারালাম!”

উর্মি দেবী কিছুটা শান্ত হলে আবার বলে উঠলো গৈরিক, “অরূপ বাবু তার ওষুধ পত্রগুলিকে কোথায় রাখতেন, উর্মি দেবী?”
“সেগুলো সব তার পড়ার ঘরের টেবিলের এক পাশে রাখা থাকে। তবে এখন অবশ্য সেই সব কিছু পুলিশের হেফাজতে।”, বললেন উর্মি দেবী।
“তবুও, একবার দেখা যাবে সেই ঘরটা?”, জানতে চাইলো গৈরিক।
“আসুন”, দুই চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলেন উর্মি দেবী। তারপর গৈরিক আর টুসুকে বাড়ির দোতলায় অবস্থিত অরূপ বাবুর স্টাডি রুমের ভেতর নিয়ে এলেন তিনি। বেশ বড় সাজানো গোছানো ঘরটি, চারিদিকে বইয়ে ভর্তি সো-কেস। মাঝে একটি বড় সেন্টার টেবিল। এখানেও বই পত্র রাখা রয়েছে, রয়েছে পেন-স্ট্যান্ড, টেবিল-ল্যাম্প এবং অরূপ বাবুর ল্যাপটপ। টেবিলের এক পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি প্লাস্টিকের ফাঁকা বাস্কেট, তার যা যাবতীয় ওষুধ পত্র সব এখানেই রাখা থাকতো, জানালেন উর্মি দেবী।

“আচ্ছা উনি না হয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতেন, কিন্তু ওই এন্টি-বায়োটিকটা তো আপনারা কেউই ব্যবহার করতেন না, তাহলে ওটা তিনি কখন কিনে আনলেন, সেই ব্যাপারে কোনো আইডিয়া আছে আপনার”, এই বাড়িতে এসে এই প্রথম মুখ খুললো টুসু।
“না ভাই, মানুষটা খুব চাপা স্বভাবের ছিলো। নিজের দরকারের সমস্ত জিনিসপত্র নিজেই জোগাড় করতে পছন্দ করতেন তিনি, এই বিষয়ে তাকে এই বাড়ির কাজের মেয়ে রাধাকেও কখনো কিছু বলতে শুনিনি আমি। তবে এটুকু দেখেছি, যে তিনি এই টেবিলেই রাখা কৌটো থেকে ওই হাই-প্রেসরের ওষুধগুলো সকাল, বিকাল এবং রাত…দিনে তিনবার করে খেতেন”, উর্মি দেবীর কথা শেষ হতেই সেই ঘরে কফির ট্রে হাতে নিয়ে হাজির হল একটি বছর তিরিশের মহিলা। সাদামাটা চেহারা, ময়লা গায়ের রঙ। বোঝাই যাচ্ছে, যে এই হল রাধা। উর্মি দেবী সকলের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

মেয়েটি সকলের উদ্দেশ্যে নমস্কার জানিয়ে চলে যাওয়ার আগে, গৈরিক তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তা তুমি কি চব্বিশ ঘন্টা এই বাড়িতেই থাকো নাকি, রাধা?”
“না বাবু, রাতের বেলা নিজের বাড়ি চলে যায়। আসলে বাপের শরীরটা খুব একটা ভালো নয় বাবু, রাত্রে বুড়ো মানুষটাকে একা ফেলে রাখতে মন চায় না। সকাল থেকে বিকাল অবধি এই বাড়িতেই থাকি।”, এই কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল রাধা।
“আচ্ছা, অরূপ বাবুর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিনে কি এই বাড়িতে বাইরের কেউ এসেছিলো?”, হঠাৎ কি মনে হতে উর্মি দেবীকে জিজ্ঞাসা করলো টুসু।
“সকালের দিকে তো নয়”, একটু চিন্তা করে বলে উঠলেন উর্মি দেবী, “কলেজ থেকে সাসপেন্ড হয়ে তো তিনি সর্বক্ষণ বাড়ির এই ঘরেই বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতেন। তবে বিকালের দিকে আমি একটু বাইরে বেরিয়ে ছিলাম, টুকটাক কেনাকাটা ছিল তাই। সন্ধ্যার পর বাড়ির কাছে এসে দেখলাম, যে দেবাশিস বাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে স্টার্ট দিতে বললেন….”

তার কথা শেষ না হতেই কৌতূহলী কণ্ঠে বলে উঠলো টুসু, “আচ্ছা, এই দেবাশিস বাবুটা কে?”
“ভারী নচ্ছার লোক, ভাই”, বলে উঠলেন উর্মি দেবী, “তিনি সোদপুরের একজন প্রমোটার। আসলে সোদপুরে আমার স্বামীর এক দূরসম্পর্কের মামার পৈতৃক ভিটে আছে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। মৃত্যুর আগে, একমাত্র বংশধর হিসাবে পুরোনো আমলের এই বাড়িটিকে তিনি ওনার নামে দিয়ে যান। সেটাকে ভেঙে সেই স্থানে একটি ফ্ল্যাট তৈরি করতে চান এই দেবাশিস গোস্বামী। কিন্তু মামার এই শেষ স্মৃতিটাকে এই ভাবে হারাতে চাইছিলেন না আমার স্বামী। সেই জন্য জোঁকের মত ওনার পেছনে লেগে ছিলেন এই দেবাশিস বাবু!”
গৈরিক কিছুক্ষন চিন্তিত মুখে কি যেন ভেবে চলল, তারপর বলল, “এই প্রমোটারের অফিসের ঠিকানা কি আপনার কাছে আছে, উর্মি দেবী?”
“এই রে, আমি তো কখনো সেখানে যাই নি, তবে সোদপুরের ‘গোস্বামী বিল্ডার্স’ বলে ইন্টারনেটে সার্চ করলে, আশা করি অবশ্যই পেয়ে যাবেন তার অফিসের ঠিকানা।”

ঠিক এমন সময় নিচ থেকে রাধা উর্মি দেবীকে ডেকে বললো যে লন্ড্রি থেকে লোক এসেছে পয়সা নিতে। উর্মি দেবী একটু বিরতি চেয়ে নীচে চলে গেলে, টুসুর মোবাইলেও এলো কলেজের কিছু পড়াশোনা সংক্রান্ত তার বান্ধবীর একটি জরুরি ফোন। সেই ঘরে ফোনের নেটওয়ার্কটা ঠিক ভাবে না আসায়, টুসু সেখান থেকে বেরিয়ে বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে যথাসম্ভব কম কথা বলে আবার ঘরে ফিরে এলো। মুহূর্তের মধ্যে তার যেন মনে হল, যে গৈরিক কোনো একটি সাদা কাগজের টুকরো বিদ্যুৎবেগে নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করলো। এমন সময় নিচের কাজ সেরে আবার ঘরে প্রবেশ করলেন উর্মি দেবী।

গৈরিক মজা করে হেসে বলে উঠলো, “আপনার রাধা কিন্তু বেশ ফাঁকিবাজ হয়ে উঠেছে!” এই বলে সে হাতের একটি আঙ্গুল টেবিলের ওপর ঘষে বোঝাতে চাইলো যে তাতে কত ধুলো জমেছে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে উর্মি দেবী ম্লান হেসে বললেন, “এতে ওর কোনো দোষ নেই, গৈরিক বাবু। এই কয়েক দিনে আমার যা মানসিক অবস্থা হয়েছিলো, আমাকে সামলাতেই ওর গোটা দিন লেগে যাচ্ছিলো।”

অরূপ বাবুর বাড়ি থেকে ফিরতি পথে, টুসুর অবশ্য খুব জানতে ইচ্ছা করছিলো, যে গৈরিক একটু আগে নিজের পকেটে ওটা কি ঢোকালো, কিন্তু সে জানে যে এখন এই সংক্রান্ত কোনো কথাই তাকে বলবে না তার গেরোদা। অগত্যা কিছু না বলাই ভালো।

(৩)


পরদিন সকালেই গৈরিক আর টুসু পৌঁছে গিয়েছিলো সোদপুরে অবস্থিত ‘গোস্বামী বিল্ডার্স’-এর অফিসে। সোদপুর স্টেশন থেকে অনতিদূরে, এই সংস্থারই তৈরি একটি বহুতলী ফ্ল্যাটের নীচে এই অফিস। গুগল করে খুব সহজেই পাওয়া যায় এই ঠিকানা, বোঝাই যাচ্ছে, যে এই দেবাশিস গোস্বামী হলেন সোদপুরের বেশ বিত্তশালী প্রমোটারদের মধ্যে একজন। বেশ সাজানো গোছানো অফিস ঘরে তিনি ছাড়াও কাজ করে আরো দুজন কর্মচারী।

দেবাশিস বাবুর বয়স আন্দাজ বিয়াল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশের মধ্যে, বেশভূষায় শৌখিনতার ছাপ। দেখতেও যথেষ্ট সুপুরুষ তিনি। তবে এহেন গোয়েন্দা এবং তার সহকারীর আগমনে যে তিনি খুব একটা খুশি হননি, সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। বেশ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই, অন্য কাজের তাড়া দেখিয়ে তিনি প্রাথমিক পরিচয় পর্ব সারলেন। এরপর গৈরিক তার উদ্দেশ্যে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “উর্মি দেবীর কথামত আপনি সেদিন সন্ধ্যায় অরূপ বাবুর সাথে দেখা করতে যান। সেখানে গিয়ে তার সাথে আপনার ঠিক কি কি কথাবার্তা হয়?”

বেশ ভরাট গমগমে পুরুষালি কণ্ঠে বলে উঠলেন দেবাশিস বাবু, “শুধু সেদিন নয়, ওনার জীবিত কালে প্রায়ই আমি ওনার সাথে দেখা করতে যেতাম। কারণটাও নিশ্চয় ওনার স্ত্রী আপনাদের জানিয়েছেন। সেদিনও এই উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলাম, যে টাকার অঙ্কটা একটু বাড়িয়েও যদি ওনাকে ওই বাড়িটা আমাকে বিক্রি করতে রাজি করাতে পারি…কিন্তু তিনি তার কলেজের ওই ব্যাপারটা নিয়ে এমনিতেই খুব ডিপ্রেসড ছিলেন। আমার কথায় রাজি হওয়া তো দূরের কথা, তিনি আমাকে যা নয় তাই বলে অপমান করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেন!”

“সেকি! এতো খুব দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি, মশাই!”, ব্যাঙ্গের সুরে বলে উঠলো গৈরিক, “আপনার মত মানুষকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া! সত্যিই অরূপ বাবুর সাহস বলিহারী!…আচ্ছা, আপনি নিশ্চয় ওনার স্টাডি রুমে বসেই ওনার সাথে কথা বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো?”, উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলেন দেবাশিস বাবু।
সেই কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো গৈরিক, “আচ্ছা, ওনার সাথে কথা বলার সময় কোনো মুহূর্তে কি আপনি ওই ঘরে একলা কিছুক্ষন কাটিয়েছিলেন?”
“উনি পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যে একবার ওয়াশ-রুমে গিয়েছিলেন, তখন ওই ঘরে আমি একাই ছিলাম….কিন্ত খুব আশ্চর্যের বিষয় তো, এই সব কথা আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?”, বিরক্ত হয়ে বললেন দেবাশিস বাবু।

গৈরিকের হয়ে, এবার মুচকি হেসে উত্তর দিলো টুসু, “বিষয়টা বোঝা সত্যিই কি খুব কঠিন, মিস্টার গোস্বামী? অরূপ বাবুর মামার বাড়িটা পাওয়ার পথে উনিই ছিলেন অপনার জন্য সবচেয়ে শক্ত কাঁটা, ওনাকে কোনো ভাবে সরিয়ে দিতে পারলে, উর্মি দেবীর মত একজন ভেঙে পড়া একলা মহিলাকে ভয় দেখিয়ে বাড়িটা বিক্রি করতে রাজি করানোটা আপনার পক্ষে কোনো ব্যাপারই নয়!…আর আপনি নিজে মুখেই স্বীকার করলেন, যে আপনি ওই ঘরে কিছুক্ষনের জন্য একা ছিলেন। এই সুযোগে ওনার প্রেসারের ওষুধের কৌটোর মধ্যে একই রকম দেখতে এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেট মিশিয়ে দেওয়াটা কি খুব কঠিন কাজ? জানতেন আপনি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি ওই কৌটো থেকে ওষুধ বার করে খেতে চলেছেন…”

“মুখ সামলে কথা বলো!”, টুসুর কথা শেষ না হতেই গর্জে উঠলেন দেবাশিস বাবু, “মনে রেখো, তুমি তো কোন ছাড়, তোমার দাদার মত এই সব শখের গোয়েন্দারা আমার হাতের নস্যি!”
টুসুও কিছু একটা চিৎকার করে বলতে চলেছিলো, কিন্তু গৈরিক তাকে থামিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, “আপনার হাতের নস্যি আপনার হাতে হাতকড়া পরাতে পারবে কিনা, তা তো প্রমান হবে ওই ওষুধের কৌটোর গা থেকে পাওয়া ফিঙ্গার-প্রিন্ট রিপোর্টে! চল টুসু, আপাততঃ এর কাছে আমার আর কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নেই…”, এই বলে টুসুর সাথে অফিস ঘর থেকে বেরোনোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতেই, পেছন থেকে উন্মাদের ভঙ্গিতে আবার চিৎকার করে উঠলেন দেবাশিস বাবু, “হ্যাঁ, যান যান…আমাকে ফিঙ্গার-প্রিন্ট দেখাতে আসবেন না! যদি দেখাতে চান, তো গোপাল নন্দীকে দেখান! কারণ আমার আসার আগে সেও সেদিন এসেছিলো অরূপ বাবুর সাথে দেখা করতে, ওই ঘরে বসেই কথাবার্তা বলছিলো ওরা…শুধু কথাবার্তা বললে ভুল হবে, গালিগালাজ আর তর্কবিতর্ক চলছিলো দুজনের মধ্যে…”

গৈরিক কৌতূহলী হয়ে আবার পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ালো দেবাশিস বাবুর দিকে মুখ করে, তারপর জিজ্ঞাসা করলো, “কে এই গোপাল নন্দী?”
নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলে উঠলেন দেবাশিস বাবু, “গোপাল বাবু হল অরূপ বাবুর কলেজের একই ডিপার্টমেন্টের ল্যাবরেটরির এক এসিস্ট্যান্ট। কিছুদিন আগে অরূপ বাবু নাকি প্রমান করে দেন, যে সরকারের পয়সায় ল্যাবের কাজের জন্য যে সকল জিনিসপত্র আসে, তার বেশির ভাগটাই এই গোপাল নন্দী আত্মসাৎ করে। তারপর তা চড়া দামে অন্যত্র বেচে দেয়। এর ফলে গোপাল বাবুর চাকরি চলে যায়, কয়েক মাসের জন্য জেলও খাটতে হয় তাকে। ওই ঘরে গিয়ে ওদের কথা যেটুকু শুনেছিলাম, তাতে বুঝেছিলাম যে সেই দিনই বোধহয় জেল থেকে ছাড়া পায় গোপাল। তবে আমি আসার পরই আর অরূপ বাবুর সাথে কোনো কথা না বাড়িয়ে সে কেটে পরে ওখান থেকে। তাই প্রতিহিংসার বশে, প্রেসারের ওষুধের মধ্যে এন্টি-বায়োটিক মিশিয়ে দেবার মত সুযোগ বা জ্ঞান কিন্তু তারও ছিলো, মিস্টার সেন!”

এরপর দেবাশিস বাবুর সাথে আর বেশি কথা বাড়ায়নি গৈরিক। গোপাল নন্দীর বাড়ির ঠিকানা দেবাশিস বাবুর জানার কথা নয়। অগত্যা গৈরিক আর টুসু ‘গোস্বামী বিল্ডার্স’ থেকে বেরিয়ে রওনা হল সেই থানার উদ্দেশ্যে, যেখানে গোপাল বাবুর বিরুদ্ধে ওই চুরির কেস রেজিস্টার করা হয়েছিলো।

(৪)


আমা স্ট্রিট থানা থেকে গোপাল নন্দীর ঠিকানা জোগাড় করে সেদিন বিকালেই গৈরিক আর টুসু পৌঁছে গিয়েছিলো গড়িয়াহাটে অবস্থিত তার ছোট্ট একতলা বাড়িতে। সত্যিই মানুষটার বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুব সঙ্গিন। ক্ষণিকের লোভের বশবর্তী হয়ে চাকরি হারিয়ে, জেল খেটে স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েছে বেচারা।

“হ্যাঁ, সেদিনই সকালে জেল থেকে ছাড়া পাই আমি”, কালো হৃষ্ট-পুষ্ট বেঁটে চেহারার গোপাল নন্দী বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে হাত পা নাড়িয়ে বলে উঠলো, “তারপর সেদিন বিকালেই অরূপ বাবুর সাথে দেখা করতে যাই আমি। তাকে জিজ্ঞাসা করতে যাই, যে তার মত লাখ টাকা মাইনে তো আমার নয়, তাহলে আমি যদি বাঁকা পথে দু-পয়সা ইনকাম করেই থাকি, তাতে তার কোন পাকা ধানে মই পড়লো?”
“তার মানে এভাবেই বেশ ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়ে যায় আপনাদের দুজনের মধ্যে, তাই তো?”, জিজ্ঞাসা করলো টুসু।
“প্রথমে তা নয়। তার কাছে গিয়ে সবার প্রথমে আমি নিজের ভুল বুঝে ক্ষমা চাওয়ার অভিনয় করি! ভেবেছিলাম, যে এই ভাবে তার কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা ধার নিতে পারবো। বুঝতেই পারছেন, এখন সংসারের যা অবস্থা… কিন্তু তিনি এক পয়সাও আমাকে দিতে রাজি হলেন না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন! তখন আমি নিজের আসল রূপ ধরলাম, ওনার সাথে শুরু হল ঝগড়াঝাঁটি! আমার তো মনে হচ্ছিলো ওই শালাকে জন্মের মত শেষ করে দিতে…”, চিৎকার করে উঠলো গোপাল।

“আর সেই জন্যই আপনি ওনার কোনো অনুপস্থিতিতে সুযোগ বুঝে ওনার প্রেসারের অসুধের কৌটোর ভেতর ওই এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেট মিশিয়ে দিলেন, তাই তো? আপনি যখন সিটি কলেজের ফিসিওলজি ডিপার্টমেন্টের ল্যাবে কাজ করতেন, তখন এই বিষয়ের ওপর কিঞ্চিত জ্ঞান আপনার নিশ্চয় আছে। তাই, এই দুটি ড্রাগের সমবেত বিষক্রিয়ার কথাও আপনার অজানা নয়!”, দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো গৈরিক।
এই কথা শুনে পাংশু বর্ণ হয়ে উঠলো গোপালের মুখ, সে দুই হাত জোর করে কেঁদে উঠলো, “না বাবু, না! রাগের মাথায় অরূপ বাবুকে খুন করার কথা আমার মাথায় এসেছিলো মাত্র, কিন্তু ওই সব ওষুধপত্র মিশিয়ে দেওয়ার কথা কখনো ভেবে দেখিনি, বাবু! সে সুযোগও আমার ছিলো না, কারণ যতক্ষণ আমি ওই বাড়িতে ছিলাম, তিনি আমার সামনেই ছিলেন…তবে…”
“তবে কি? এই বিষয়ে কি আপনার অন্য কাউকে সন্দেহ হয়?”, জিজ্ঞাসা করলো টুসু।

নিজেকে কিছুটা শান্ত করে তিনি বলে উঠলেন, “দেখুন দিদি, সঠিক ভাবে বলতে পারবো না। তবে আমার মনে হয়, যদি অরূপ বাবু আত্মহত্যা নাই করে থাকেন, তাহলে ওই ওষুধ মিশিয়ে তাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য কিন্তু আরও একজনের থাকতে পারে… সে হল ওনার বাড়ির কাজের মেয়েটা, কি যেন ওর নামটা… হ্যাঁ, মনে পড়েছে… রাধা!”
অবাক হয়ে টুসু বলে উঠলো, “সে কি! আপনার এমন মনে হওয়ার পেছনে কারণ?”
“মেয়েটা খুব একটা ভালো নয়, দিদি”, ফিসফিস করে বলে উঠলো গোপাল, “লোক মুখে শোনা কথা, অরূপ বাবুর সাথে ওনার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হত সে! আমি সেদিন যখন ওনার বাড়ি পৌঁছলাম, সেই সময়ও ওনার স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। বাড়ির নীচ থেকেই রাধা আর অরূপ বাবুর মধ্যে একটা কথা কাটাকাটির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো। অরূপ বাবুর পাড়ার অনেকেই বলে, যে রাধার বর একটি ওসুধের দোকানে কাজ করতো। এখন যদিওবা সে অন্য মেয়ের সাথে কেটে পড়েছে, তবুও তার কাছ থেকেই রাধার ওই দুটি ওষুধের সম্পর্কে জানা খুব একটা অসম্ভব নয়, তাই না?”

টুসুর যেন মনে হল, যে তার মাথার ভেতর সব কিছু গুলিয়ে গেল! এ বলছে ও দোষী, তো ও বলছে এর ওপর আমার সন্দেহ। সত্যিই বড্ড জটিল এই কেসটা, এখনো তো বোঝাই যাচ্ছে না যে অরূপ বাবুর মৃত্যুটা আত্মহত্যা নাকি খুন, তো খুনিকে সনাক্ত করা অনেক দুরের কথা। যাই হোক, আর অল্প কিছু সাধারন কথাবার্তার পর ওরা দুজনে বেরিয়ে এলো গোপাল নন্দীর বাড়ি থেকে।

(৫)


পরের দিন সকাল থেকে গৈরিক নিজের কি যেন একটা ব্যক্তিগত কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলো, তাই গোটা দিন আর এই কেস নিয়ে একটুও এগোনো গেল না। এই ধরণের পরিস্থিতি টুসুর জন্য সত্যিই খুব অস্বস্তিকর। প্রতিটা কেসের শুরু থেকে যতক্ষন না তার গেরোদা আসল অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারছে, ততক্ষণ বোধহয় গৈরিকের থেকেও আরো বেশি আহার নিদ্রাহীনতায় ভোগে টুসু। কবে যে সে নিজেও তার গেরোদার মত এমন জটিল সব কেসের সমাধান করতে পারবে!

সেদিন বিকালে কলেজের পড়াশোনা সংক্রান্ত বিষয়ে টুসু গিয়েছিলো টালিগঞ্জে, তার এক বান্ধবীর বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। নবীনা সিনেমার সামনে তখন বিশাল ভিড়, কোন একটি ডিটেক্টিভ সিনেমার আজ ফার্স্ট ডে ইভিনিং শো। টুসুও ভাবছিলো, টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়বে কি না, এমন সময় তার চোখ চলে গেল রাস্তার ওপাশে। সেখানে একটি বহুতলী আবাসনের ভেতর থেকে যে বেরিয়ে রাস্তায় এলো, তাকে দেখে হকচকিয়ে গেল টুসু…এ তো রাধা! টুসু লক্ষ্য করলো, যে সেই বহুতলীর দোতলায় আছে কোনো অফিস ঘর। একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করতেই, এই সন্ধ্যার অন্ধকারে রাস্তার আলোতেই সে দেখতে পেল, যে সেই অফিসঘরের বাইরের দেওয়ালে আটকানো ব্যানারের গায়ে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে ‘মা সারদা আয়া সেন্টার’।

টুসু ছুটে গেল রাস্তার ওপারে, রাধার কাছে। তাকে এখানে দেখে রাধাও যেন বেশ আশ্চর্য হয়েছে। টুসু হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি গো…তুমি এখানে? এই সময়?”
রাধা মুখে কৃত্রিম হাসি এনে বলে উঠলো, “আসলে আজকে তো মাসের সাত তারিখ, দিদি…তাই এখানে এসেছিলাম মাইনে নিতে।”
এই বার টুসুর কাছে পরিষ্কার হল ব্যাপারটা, ওরা দুজনে এক সাথে হাঁটতে লাগলো পাকা রাস্তা দিয়ে। টুসু বলে উঠলো, “আচ্ছা, তো তোমাকে এই আয়া সেন্টার অরূপ বাবুর বাড়িতে নিয়োগ করেছে বুঝি?”
“হ্যাঁ দিদি, তবে এখানকার নিয়ম হল যে যারা আমাদের কাজে লাগাচ্ছেন, তারা সরাসরি আমাদের মাইনে দিতে পারবেন না। প্রতি মাসে তারা পয়সা দেবেন এখানে, আর আমাদের এখানে এসে মাইনে নিয়ে যেতে হবে।”, প্রত্যুত্তর দিলো রাধা।

এবার প্রসঙ্গ পাল্টে টুসু তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “একটা কথা সত্যিই করে বলো তো রাধা, তোমার কি অরূপ বাবুর সাথে কোনো শারীরিক সম্পর্ক ছিলো?”
এই কথা শুনে মাথায় বজ্রপাত ঘটার মত চমকে উঠলো রাধা, তারপর একবার ঢোক গিলে বলে উঠলো, “কে..কেন, এই কথা কে বললো আপনাদের?”
“যেই বলে থাকুক না কেন, সত্যিটা কিন্তু আমাদের জানানো তোমার নিজের পক্ষেই ভালো, রাধা”, বিজ্ঞের মত বলে উঠলো টুসু।
এবার যেন একটু ভেঙে পড়লো রাধা, রাস্তার পাশে থাকা একটি বসার জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। টুসুও নাছোড়বান্দা, সেও গিয়ে বসলো তার পাশে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রাধা, “কি করবো বলুন দিদি? এই কটা টাকা মাত্র মাইনে, বাড়িতে অসুস্থ বাপ। তার চিকিৎসার পেছনেই পুরোটা ঢেলে দিতে হয়… বৌদির অনুপস্থিতিতে দাদাবাবুই আমায় মাঝে মাঝে ওই প্রস্তাব দিতেন। বেশ কিছু পয়সা কড়িও দিয়েছিলেন ওর জন্য!…কিন্তু ইদানিং কেমন যেন একটা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, কাজ সেরেও পয়সা বাকি রাখতে শুরু করলেন। আর সেই দিন তো গোপাল বাবুর আসার আগে এই নিয়েই আমাদের মাঝে খুব কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো!”

“আর সেই জন্যই কি রেগে গিয়ে তাকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করলে, সুযোগ বুঝে তার প্রেসরের ওষুধের মধ্যে ওই এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেট মিশিয়ে দিয়ে?”, কড়া স্বরে বলে উঠলো টুসু।
রাধা আঁতকে উঠলো এই কথা শুনে, “না, দিদি, এ কি বলছেন আপনি! এই কাজ আমি কখনো করতে পারি না, কখনো না! হ্যাঁ, সেদিন ওই উপরি পাওনা নিয়ে আমার ঝগড়া হচ্ছিল দাদাবাবুর সাথে, কিন্তু আমি জানতাম যে একদিন তিনি আমার সব টাকা মিটিয়েই দিতেন!”
এই কথা শুনে বেশ নিরাশ হল টুসু, কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ক্লান্ত গলায় সে বললো, “ঠিক আছে, না হয় মানলাম তোমার কথা। তবে তোমার কি মনে হয়, যদি অরূপ বাবু আত্মহত্যা না করে থাকেন, তাহলে কে তাকে মারতে চাইবে?”

এবার যেন আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো রাধার ঠোঁটদুটি। সে দুই হাত দিয়ে টুসুর হাতটিকে আঁকড়ে ধরে বলে উঠলো, “দিদি গো, সত্যিই বলছি আমি! ওই বাড়িটা ভালো নয়! ওই বাড়ির ওপর ভূত প্রেতের ছায়া আছে, বিশ্বাস করুন আমার কথা! নিজে চোখে দেখেছি আমি…আগে রাত্রে ওই বাড়িতেই থাকতাম আমি। বেশ কয়েক বার রাত্রে বাগানের ভেতর একটা সাদা পোশাক পরা আবছা পুরুষের ছায়ামূর্তিকে স্পষ্ট দেখেছি আমি! এ আমার চোখের ভুল নয় গো, সেই জন্যই ওই বাড়িতে রাতে থাকা বন্ধ করে দিলাম আমি, বাপের অসুস্থতার বাহানা করে! উর্মি বৌদি এই সব কথা বিশ্বাস করেন না, তাই সেদিন ওনার সামনে আপনাদের এই কথা আমি বলিনি।”
টুসু অবাক হয়ে শুনছিলো রাধার কথা, তারপর সে বলে উঠলো, “তো তোমার মনে হচ্ছে যে ভূত এসে তোমার দাদাবাবুর প্রেসারের ওষুধের কৌটোয় এন্টি-বায়োটিক রেখে গিয়েছে, তাই তো?”
রাধা যেন সেটাই মনে প্রানে বিশ্বাস করে, সে তখনও সেই সাদা পোশাকের প্রেতাত্মাকেই হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত করে গেল। এই সব শুনতে শুনতে টুসুরও কেন যেন গা ছমছম করে উঠলো। এদিকে রাতও বেশ হয়েছিল, অতঃপর ওরা একে অপরকে বিদায় জানিয়ে যে যার রাস্তা ধরলো।

ফিরতি পথে অটোতে বসে, এই কেসটার ব্যাপারে ভেবে টুসুর যেন মাথা ঘুরে গেল। প্রথমে সন্দেহের তীর অরূপ বাবুর নিজের ওপরই, তারপর দেবাশিস বাবু, গোপাল নন্দী, রাধা এবং সবশেষে এই ‘ভূত’! নাহ, গেরোদাকে আজ রাতেই ফোন করে বলতে হবে সব কথা। তবে একটা বিষয় বেশ রহস্যময়, ওই বাড়িতে ভূত থাকুক না থাকুক, কিছু তো একটা নিজের চোখে দেখেছেই রাধা! কি সেটা?

(৬)


পরদিন সকালেই গৈরিক আর টুসু হাজির হয় ‘মা সারদা আয়া সেন্টার’-এর অফিসঘরে। উদ্দেশ্য, রাধার সম্বন্ধে আরো ভালো ভাবে খোঁজ খবর নেওয়া। এক কামরার ছিমছাম অফিসঘর। হিসাবপত্র রাখার জন্য রাখা হয়েছে মাত্র একজন কর্মচারীকে। এই সংস্থার মালকিন হলেন ডা: মহুয়া সেনগুপ্ত। মহুয়া দেবী পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, তার নিজের একটি ছোট খাটো মানসিক রোগীদের হাসপাতালও আছে খিদিরপুরে। বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথেও তিনি যুক্ত, আর এই আয়া সেন্টারটির মূল উদ্দেশ্যই হল সমাজের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জীবিকা উপার্জনের একটি সুস্থ উপায় বার করে দেওয়া।

খুব একটা অসামান্য সুন্দরী না হলেও, বেশ চটকদার চেহারা মহুয়া দেবীর। বেশভূষাতেও খুব আধুনিকা তিনি। তার চেম্বারে বসেই তার সাথে গৈরিক আর টুসুর কথা হচ্ছিলো মূলতঃ রাধাকে নিয়ে। কিছুক্ষন আগেই বেয়ারা এসে সকলের জন্য ধূমায়িত কফির কাপ আর বিস্কিটের প্লেট রেখে গিয়েছে। তাতে একবার আলতো করে চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন মহুয়া দেবী, “মা মারা মেয়ে, অভাবের সংসার। বাবার হার্টে ব্লকেজ ধরা পড়েছে। খুব ছোটবেলাতেই বিয়ে হয়েছিলো তার, তবে সেই বরও তাকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে পালালো। এমনই দুঃখের জীবন রাধার। আমি চেয়েছি, যে মেয়েটা যেন সৎ পথে একটু খেয়ে পরে বাঁচতে পারে।”
“কিন্তু আপনি কি জানেন, যে এই মেয়েটার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো অরূপ বাবুর সাথে, যার মৃত্যুর কিনারা করতেই নেমেছি আমরা”, বলে উঠলো টুসু।
“এর জন্য কি রাধা দায়ী? নাহ, নিশ্চয় এমন কাজ করার জন্য অরূপ বাবুই তাকে উস্কেছিলেন! আসলে, মেন আর পলিগ্যামাস ফ্রম দেয়ার ভেরি বার্থ…ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকতেও বাইরের কোনো হতকুচ্ছিত মহিলার ওপরও এদের নজর থাকে! সেদিক থেকে দেখতে গেলে, শ্রীপর্ণা যে কাজটি করেছে, তা করা উচিত ছিলো রাধার…”, পুরুষ জাতির ওপর যেন সকল রাগ একসাথে উগরে দিলেন মহুয়া দেবী।

টুসু মুচকি হেসে বলে উঠলো, “সেই প্রতিবাদ কিন্তু করেনি রাধা, বরং অরূপ বাবুর এই অশালীন শারীরিক চাহিদাকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে পয়সার লোভে। তার সাথে ঝগড়াঝাঁটি তখন করেছে, যখন অরূপ বাবুকে নিজের শরীর বিক্রি করার উপযুক্ত দাম সে পায়নি! এই সম্বন্ধে আপনি কি বলতে চান, মহুয়া দেবী?”
মহুয়া দেবী আবার রাগত কণ্ঠে কিছু একটা বলতে চলেছিলেন, এমন সময় গৈরিক তাকে থামিয়ে, প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলো, “আচ্ছা, আপনি তো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। এই মেয়েটার মানসিক অবস্থার সম্পর্কে কি ধারণা আপনার?”
“মানে? ঠিক বুঝলাম না তো!”, প্রত্যুত্তরে বললেন মহুয়া দেবী।
“মানে, সে আমাদের জানিয়েছে, যে রাত্রে ওই বাড়ির বাগানে নাকি কোন অশরীরি পুরুষকে দেখেছে সে!”, বললো গৈরিক।

এই কথা শুনে এমন ভাবে চমকে উঠলেন মহুয়া দেবী, মনে হল যেন সেই অশরীরি পুরুষ এই মুহুর্তে তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। “এই ব্যাপারে তো কোনো দিন কিছু বলেনি সে আমাকে”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন তিনি, “ঠিক আছে পরে যেদিন এখানে আসবে, সেদিনই ওকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে!”
“ঠিক আছে, আমরা আজ তাহলে আসি। খুব ভালো লাগলো আপনার সাথে কথা বলে, পরে না হয় আবার দেখা হবে”, এই বলে তাকে নমস্কার জানিয়ে টুসুকে নিয়ে সেই আয়া সেন্টারের অফিস থেকে বেরিয়ে এলো গৈরিক।

ততক্ষনে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। নবীনা সিনেমার কাছটায় এখন খুব একটা ভিড় নেই। তবে সেই ডিটেক্টিভ সিনেমাটার পোস্টার দেখে বোঝা গেল, যে কিছুক্ষনের মধ্যেই আজকের দুপুরের শো শুরু হবে। গৈরিক যেন টুসুর মনের কথা বুঝে ফেললো, সে নিজের ওয়ালেট খুলে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে টুসুকে বললো, “যা দেখি, কাউন্টার থেকে দুটো টিকিট কেটে আন।”
টুসু হাসি মুখে এগিয়ে গেল কাউন্টারের দিকে। টিকিট কেটে ফেরার পথে দেখলো, যে গৈরিক কানে ফোন গুঁজে কার সাথে যেন কথা বলছে, “বাহ, ওই ওষুধের কৌটোর গা থেকে ফিঙ্গার-প্রিন্ট রিপোর্ট রেডি হয়ে গিয়েছে! তা কি বেরোলো রিপোর্টে? কার কার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেল সেখান থেকে….”
টুসু দেখলো, যে এরপর ফোনের অপর প্রান্তের বক্তার কথাগুলো শুনে গৈরিকের উৎফুল্ল ভাবটা কেটে গেল। কেমন দৃঢ় হয়ে উঠলো তার চোয়াল, গম্ভীর মুখমণ্ডলে ছেয়ে গেল কোনো অজানা চিন্তার রেশ!

(৭)


গত দুই দিন ধরে গৈরিকের কোনো পাত্তা নেই। এদিকে কেসটাও যে কোন পথে এগোচ্ছে, সেটাই বুঝতে পারছে না টুসু। কি জানি বাবা, গেরোদা এই অদ্ভুত কেসটার কোনো সমাধান করতে পারবে তো? এখনো তো এটাই বোঝা গেল না, যে অরূপ বাবুর মৃত্যুটা কি হত্যা না আত্মহত্যা। তিনি মৃত্যুর আগে নিজে মুখে কিছুই বলে যাননি। এখনো পুলিশের হেফাজতে আছে শ্রীপর্ণা। ইতিমধ্যে তার সাথেও একবার সে আর গৈরিক দেখা করতে গিয়েছিলো থানায়, যদিও বা সেখান থেকেও অরূপ বাবুর মৃত্যু-রহস্যের কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি টুসু। এদিকে, মানুষেরা সব একে একে দোষ ঠেলছে ভূতের ওপর!

এমনই সব চিন্তা নিয়ে মাথা ভার করে সেদিন দুপুরে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলো টুসু, ঠিক এমন সময় বেজে উঠলো তার মোবাইল ফোনটা। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিয়েই, বেশ উৎসাহের সাথে টুসু বলে উঠলো টুসু, “হ্যাঁ, গেরোদা, বলো….”
খুব সংক্ষেপে প্রত্যুত্তরে বললো গৈরিক, “ঝটপট তৈরি হয়ে বেহালায় অরূপ বাবুর বাড়িতে চলে আয় দেখি…”
ব্যাস আর কিছু বলতে হল না গৈরিককে, তার গলার এই স্বর টুসুর খুব চেনা। তার মানে আজকেই হতে চলেছে এই নাটকের যবনিকা পতন! উত্তেজনায় যেন টগবগ করে ফুটতে লাগলো টুসুর শরীরের সকল রক্তবিন্দু!

অরূপ বাবুর বাড়ি পৌঁছে টুসু দেখলো, যে তার বৈঠকখানার ঘরে এই নাটকের বাকি সকল চরিত্রই জমায়েত হয়েছে। রয়েছেন স্থানীয় থানার ওসি সাহেব, উর্মি দেবী, রাধা, দেবাশিস বাবু, গোপাল নন্দী, শশাঙ্ক, এমনকি শ্রীপর্ণাকেও থানা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। অদূরে বসে থাকা মহুয়া দেবীকে দেখেও বেশ আশ্চর্য হল টুসু, তার মানে তার সাথেও এই কেসের কোনো সম্পর্ক আছে, এটা তো তার মনেই হয়নি! কিন্তু মহুয়া দেবীর পাশের চেয়ারে যে সম্ভ্রান্ত চেহারার বয়স্ক ভদ্রলোকটি বসে আছেন, তিনি কে? তাকে তো এর আগে কখনো দেখেনি টুসু!

কিছুক্ষনের মধ্যেই বলতে শুরু করলো গৈরিক, “সবার প্রথমেই বলি, যে এই কেসটা হাতে নিয়ে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম, যে আর যাই হোক না কেন, অরূপ বাবু কিন্তু আত্মহত্যা করেননি। কারণ তা করার মত আরো সহজ উপায় তার হাতের কাছেই ছিলো। গলায় দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়তে পারতেন, বা নিদেনপক্ষে একগুচ্ছ ঘুমের ওষুধও গলাধঃকরণ করতে পারতেন…কিন্তু এই দুটি ড্রাগের বিষক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে…নাহ, নিজে মরতে হলে এত মাথা কেউ খাটাবে না! অরূপ বাবুকে খুন করা হয়েছে! সেই ক্ষেত্রে, শ্রীপর্ণা তার মৃত্যুর সাথে কোনো ভাবে জড়িত নয়!” হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো শ্রীপর্ণা, শশাঙ্ক তাকে জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকের ভেতর।

আবার বলতে শুরু করলো গৈরিক, “দেবাশিস বাবু, গোপাল নন্দী এবং রাধা…এই তিনজনেরই অরূপ বাবুকে হত্যা করার মোটিভ ছিলো। এরা তিনজনেরই হাসপাতালে ভর্তি হবার আগের দিন অরূপ বাবুর সাথে বচসা হয়, তাদের হাতে সুযোগও ছিলো তার প্রেসারের ওষুধের কৌটোয় ওই এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেট মিশিয়ে দেওয়ার। কিন্তু নাহ, আমার তদন্ত অনুযায়ী, এরা তিনজনই নির্দোষ। না তো এরা কেউ খুন করেছে অরূপ বাবুকে, না তো এদের কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে ওই ওষুধের কৌটোর গা থেকে!” এই কথা শুনে এরা তিনজনেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

“তাহলে খুনি কে, গেরোদা?”, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো টুসু।
“এবার দেখ ম্যাজিক”, প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে বলে উঠলো গৈরিক, “খুনি নিজের মুখেই স্বীকার করবে তার অপরাধের কথা!” এই বলে গৈরিক হাতের আঙ্গুল দিয়ে দুই বার তুড়ি বাজালো, আর ঠিক সেই মুহূর্তে সেই ঘরের পেছনের খোলা দরজার পর্দা সরিয়ে দুই জন কনস্টেবল এক সাদা পোষাক পরিহিত সুপুরুষ যুবককে সেই ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। একেও তো আগে কখনো দেখেনি টুসু! ভদ্রলোকের চেহারা সুন্দর হলেও কেমন যেন মরা মরা তার চোখের দৃষ্টি, নিরুদ্বেগ মুখের চাহনি, মাথা ভর্তি উস্কোখুস্কো চুল এবং গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তাকে দেখেই চিৎকার করে উঠলো রাধা, “আরে! এই তো সেই লোকটা যাকে মাঝে মাঝে এই বাড়ির বাগানে দেখতে পেতাম রাতে! ওকে ওভাবে দেখে ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিলাম!”

কিন্তু এর পরে যে ঘটনা ঘটলো, তা দেখে আরও চমকে ওঠার পালা টুসুর। এই নবাগত লোকটিকে দেখে কেমন যেন মুখ চোখের ভাব বদলে যেতে লাগলো উর্মি দেবীর। তার দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো, উত্তেজনায় যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো তার সর্বশরীর। সকলকে অবাক করে তিনি একটা বিকট চিৎকার করে ছুটে গেলেন সেই যুবকটির দিকে, তারপর সারা বাড়ি কাঁপিয়ে বলে উঠলেন, “সায়ন্তন…সায়ন্তন আমি তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছি, সায়ন্তন! যে মানুষটা তোমাকে মেরে ফেলেছে, তার প্রেসারের ওষুধের মধ্যে এন্টি-বায়োটিক মিশিয়ে আমিও তাকে চিরতরে শেষ করে দিয়েছি! বলো, তোমার আত্মা শান্তি পেয়েছে কি না, বলো…বলো না…”
সকলকে আরো অবাক করে সায়ন্তন নামক সেই যুবকটিও অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো, “হ্যাঁ উর্মি, এত দিন ধরে মরেও শান্তি পাচ্ছিলাম না আমি, অরূপের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার বাসনায় প্রতি মুহূর্ত ঘুরে বেড়িয়েছি এই বাড়ির প্রতিটি কোণে… এবার মুক্তি পাবো আমি…মুক্তি!”

ঠিক সেই মুহূর্তেই উর্মি দেবী জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লেন সেই যুবকটির গায়ে। গৈরিকের ইশারাতে কনস্টেবলরা ওই যুবককে তখনই সেই ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেল। উর্মি দেবীর জ্ঞানহীন দেহটিকে পাশে রাখা সোফার ওপর হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হল। সকলে যেন অবাক হয়ে এতক্ষন ধরে একটি যাত্রাপালার শেষ দৃশ্য দেখছিলো, এবার উদগ্রীব হয়ে উঠলো গৈরিকের ব্যাখ্যা শোনার জন্য!

(৮)


“তুই বোধহয় সেদিন দেখে ফেলেছিলিস, টুসু”, বলতে শুরু করলো গৈরিক, “যে আমি সেদিন ওপরের ঘর থেকে একটি কাগজের টুকরো নিজের পকেটে চালান করি। সেটা ছিলো একটা ওষুধের দোকানের বিল। যাতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা ছিলো ওই এন্টি-বায়োটিক ট্যাবলেটের নাম, দাম এবং কেনার তারিখ যা কিনা অরূপ বাবুর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একদিন আগে। এছাড়াও, এই ওষুধটার সাথে আরেকটি বস্তুও ওই দোকান থেকে কেনা হয়েছে একই সময়ে…সেটা হল একটি গ্লাভস। সেই দোকানে একটু খোঁজ নিজেই জানতে পারলাম এই দুটি দ্রব্যের ক্রেতা আর কেউ নয়, স্বয়ং উর্মি দেবী। দোকানের সিসিটিভি ফুটেজেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো তাকে।”

“অরূপ বাবুর সম্বন্ধে কলেজ থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যে তিনি পি.এইচ.ডি করেছেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আরো কয়েকটা তথ্য। প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা। অরূপ বাবুর মত, সেটাই ছিল পি.এইচ.ডি-র ফাইনাল ইয়ার আরো একজন গবেষকের জন্য…এবং তিনিই হলেন এই সায়ন্তন বাবু…মানে ডা: সায়ন্তন চক্রবর্তী! আর ঠিক সেই সময়ই এম.এস.সি-র প্রথম বর্ষে সেখানে ভর্তি হন উর্মি দেবী। এই তিন জনের মধ্যে শুরু হয় এক সম্পর্কের টানাপোড়েন। উর্মি দেবী আর সায়ন্তন বাবু একে অপরকে ভালোবাসতেন, কিন্তু উর্মি দেবীর প্রতি অরূপ বাবুর প্রেম ছিলো এক তরফা!”

“এদিকে ডক্টরেট ডিগ্রি হাসিল করেই অরূপ বাবু অধ্যাপনার চাকরি জুটিয়ে ফেলেন। সায়ন্তন বাবু ছিলেন তখনো বেকার। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না অরূপ বাবু, কারণ সায়ন্তন বাবু ছিলেন বেশ স্বচ্ছল পরিবারের সদ্য মাতৃ পিতৃহারা একমাত্র বংশধর। উর্মি দেবী তার সাথেই বিয়ে করার কথা ঠিক করলেন। ঠিক এই সময়ই মোক্ষম চালটা চাললেন অরূপ বাবু!”, এতটা বলে গৈরিক হঠাৎ তাকালো মহুয়া দেবীর পাশে বসা সেই অচেনা বয়স্ক ভদ্রলোকটির দিকে, তারপর বললো, “কি ডক্টর শতদল মজুমদার, বাকি অংশটা বরং আপনার মুখেই শুনি…”

সেই ভদ্রলোক এবার নতমুখে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমি ছিলাম সায়ন্তনের পরিবারের বহুদিনের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান। ওরা সকলেই ছিলো আমার চিকিৎসার অন্ধ-ভক্ত। কিন্তু একটা দোষ আমার ছিলো, নারী শরীরের প্রতি আসক্তির দোষ। বিয়ে করিনি, তাই সেই চাহিদা পূরণ করতে যেতে হত বাজারের মেয়েদের কাছে। অরূপের সায়ন্তনের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল, তাই সে চিনতো আমাকে। জেনে ফেলেছিলো আমার নিষিদ্ধ-পল্লীতে যাওয়ার কথা। এমনই একটি মেয়েকে পয়সা খাইয়ে, সে তার সাথে আমার সঙ্গম দৃশ্যের কিছু অশ্লীল ছবি আয়ত্ত করে। অরূপ সেগুলো দিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেল করে, বলে যে যেভাবেই হোক সায়ন্তনের সাথে উর্মির বিয়েটা আমাকে ভেঙে দিতে হবে!”

“আর তাই যখন সাধারণ কোনো কারণ বশতঃ সায়ন্তন বাবু শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, আপনি তার ব্লাড টেস্ট করিয়ে একটি ফেক রিপোর্ট নিয়ে আসেন, যাতে বলা ছিলো যে সায়ন্তন বাবু ব্লাড ক্যানসারের লাস্ট স্টেজের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন! তিনি দেবতার মত বিশ্বাস করতেন আপনাকে, তাই এই কথাই মনে নিলেন। অপর কোনো চিকিৎসকের কাছে গেলেন না”, বলে উঠলো গৈরিক।

“হ্যাঁ”, বললেন শতদল বাবু, “সেই মুহূর্তে সায়ন্তন এতটাই ভেঙে পড়লো, যে নিজেই উর্মির সাথে বিয়ে ভেঙে দিতে চাইলো। সে জানতো, যে এই কথা জানার পরও উর্মি তাকে ছাড়তে চাইবে না, তাই সে অরূপকে গোপনে ডেকে উর্মির সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে নিজে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। নিজেকে এই পৃথিবীর অল্প কিছুদিনের অতিথি মনে করে, সে চাইলো না উর্মির সাথে বিয়ে করে তার জীবনটা নষ্ট করতে। আমিই তাকে গোপনে একটি বাড়ি ভাড়া জোগাড় করে দিলাম। এর মধ্যেই কেটে গেল এক বছর। উর্মির কাছে সায়ন্তনের কোনো হদিস ছিলো না, এর মধ্যেই অরূপ তাকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেটে পড়া এক বিশ্বাসঘাতক প্রমান করতে সফল হল উর্মির কাছে। বেশ কিছুদিন আপত্তি করেও, শেষে উর্মি রাজি হল অরূপকে বিয়ে করতে।”

“বাকিটা আপনার মুখ থেকে শুনবো, মহুয়া দেবী”, দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো গৈরিক। বিন্দুমাত্র অসম্মতি প্রকাশ না করে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন মহুয়া দেবী, “এই পরিস্থিতিতে, আসন্ন মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে, ডিপ্রেশনে ভুগে সায়ন্তন বাবু একটি ভয়ঙ্কর মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেন, সাইকোলজির পরিভাষায় যাকে বলে ‘Cotard Delusion’. এই রোগে একজন মানুষ সশরীরে বেঁচে থাকলেও, তার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে সে মৃত! সে নিজেই নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, নিজেকে মনে করে একজন অশরীরি! তাই বাধ্য হয়েই শতদল বাবু সায়ন্তন বাবুকে আমার মানসিক রোগের হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রথম দেখাতেই আমি সায়ন্তন বাবুর প্রতি আকৃষ্ট হলাম, মনে প্রানে তাকে ভালোবেসে ফেললাম!”

“এর পর আমি ধীরে ধীরে সায়ন্তন বাবুর আরো কাছে আসতে শুরু করলাম। অনেক কষ্টে, বার বার ওনার কাউন্সেলিং করে জানতে পারলাম যে উনি মনে করেন যে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ওনার মৃত্যু হয়েছে। আমি গোপনে ওনার ব্লাড টেস্ট করলাম, কিন্তু সেখানে এই রোগের চিহ্ন মাত্র পেলাম না! বুঝতেই পারলাম, যে তিনি আসলে এক ভয়ানক প্রতারণার শিকার! যেহেতু এই বিষয়ে শতদল বাবু আমায় নিজে থেকে কোনো বিষয় বলেননি, আমি কাজে লাগলাম ওনার নারী দেহের প্রতি অতিমাত্রায় কামনা বাসনাকে। একদিন মদের নেশায়, আমার উলঙ্গ শরীরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি অকপটে স্বীকার করলেন সব কথা।”

“আর তখন আমি ঠিক করলাম, যেভাবে সায়ন্তন বাবুর সাথে প্রতারণা করে তাকে এই মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দেওয়া হল, আমিও একই ভাবে অরূপ বাবু আর উর্মি দেবীর সুখের সংসার ছারখার করে দেবেন। এই মানসিক রোগের পেশেন্টরা ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে তাদের প্রতি, যারা তাদের মৃত হওয়ার কথা অস্বীকার করে। তাই আমি সব সময় তার সামনে এই কথা মেনে নেবার অভিনয় করলাম, যে তিনি মৃত! কিন্তু তাকে বোঝাতে লাগলাম, যে তার মৃত্যুর কারণটা ব্লাড-ক্যানসার নয়, অরূপ বাবু গোপনে খুন করেছেন তাকে! মানসিক ইনস্টেবিলিটি থাকার কারণে তিনি মেনেও নিলেন এই কথা। এই প্রক্রিয়াকে সাইকোলজির পরিভাষায় বলা হয় ‘Memory Manipulation’.”

“কাকতালীয় ভাবে, সেই সময় অরূপ বাবু নিজেই আমার আয়া সেন্টারে যোগাযোগ করলেন একটি কাজের লোকের খোঁজে। আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম! রাধাকে পাঠালাম তাদের বাড়িতে। ওর থেকেই প্রতিনিয়ত ওনার পরিবারের ছোট বড় সকল খবরাখবর পেতে লাগলাম। তবে রাধাকে কখনো জানতে দিইনি আমার অভিসন্ধির কথা….প্ল্যান মাফিক, আমি বেশ কয়েকদিন রাতে সায়ন্তন বাবুকে নিয়ে যেতাম অরূপ বাবুর বাড়ির বাগানে। জানতাম আমি, যে উর্মির ভালো ঘুম হয়না, তাই কোনোদিন সে তার চোখে পড়বেই। আর হলও তাই! রাতের অন্ধকারে প্রতিনিয়ত সাদা পোশাকে সায়ন্তন বাবুকে দেখে উর্মির মনে হল যে এটা তার প্রেতাত্মা! এদিকে আমার শেখানো বুলিই সায়ন্তন বাবু আওড়াতেন উর্মি দেবীর সামনে, যে তাকে অরূপ বাবু গোপনে খুন করেছেন…তার প্রতিশোধ চাই! বোধহয় এমনই কোনো দিন রাধাও দেখে ফেলেছিলো সায়ন্তন বাবুকে।”

“আমার উদ্দেশ্য সফল হল, উর্মি দেবীর মধ্যে দুটি সত্তা কাজ করতে লাগলো। একটিতে ছিলো তার নিজের স্বামীর প্রতি কর্তব্যবোধ এবং আনুগত্য, এবং অপরটিতে জাগ্রত হল পুরোনো প্রেমিকের এই নিদারুণ পরিণতির জন্য স্বামীর প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা। তিনি হলেন ‘Dissociative Identity Disorder’ নামক মানসিক রোগের শিকার। হয়তো এর জন্য দায়ী তার ছোটবেলায় বাবাকে হারানো, সৎ বাবার দ্বারা যৌন নিগ্রহ তথা পরিবারকে ছেড়ে বোর্ডিং স্কুলে থাকার ট্রমাগুলি। আর এই দ্বিতীয় সত্তার অধীনে এসে তিনি কি করেছেন, তার প্রমান তো আপনার কিছুক্ষন আগেই পেলেন।”

এতক্ষন পর আবার বলতে শুরু করলো গৈরিক, “যেহেতু উর্মি দেবী হাতে গ্লাভস পরে ওই প্রেসারের ওষুধের কৌটোতে এন্টি-বায়োটিক রেখেছেন, তাই ফিঙ্গার-প্রিন্ট রিপোর্টে একমাত্র অরূপ বাবু ছাড়া আর কারোরই আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সেই দিনই দ্বিতীয় সত্তার অধীনে এসে, সুযোগ বুঝে তিনি করেছিলেন এই কাজ। ফিজিওলজি নিয়ে পড়াশোনা করার ফলে ওই দুটি ড্রাগের বিষয়ে তার কিছু অজানা ছিলো না। গ্লাভসটাকেও এই বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। তবে মানসিক দোলাচলের অস্থিরতায়, ওষুধের বিলটা এই ঘরের গার্বেজের মধ্যেই ফেলে রাখলেন। আর রাধাও এই কয়দিন গার্বেজগুলিকে বাইরে ফেলার সুযোগ পায়নি, সেই কথা তো আমরা আগেই শুনেছি।”

“এবার বলি, আমি এত কিছু জানতে পারলাম কি ভাবে। খিদিরপুরে মহুয়া দেবীর মানসিক রোগের হাসপাতালে গোপনে খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারলাম একটি অদ্ভুত কথা। এখানে নাকি এক সুদর্শন পুরুষ বেশ কিছু দিন ধরে ভর্তি আছেন, মহুয়া দেবী নাকি তাকে নিজের কোন এক আত্মীয় হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। তাকে নাকি মাঝে মাঝে রাত্রি বেলায় এখান থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান ডিনার খাওয়াতে!…সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো রাধার দেখা সেই অশরীরি পুরুষের কথা! ওই হাসপাতালেরই বিভিন্ন কর্মচারীদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে সায়ন্তন বাবুর সম্পর্কে আরো তথ্য অর্জন করলাম, পেলাম তার আসল ও নকল ব্লাড-টেস্টের রিপোর্ট গুলিও। সেখান থেকেই উঠে এলো শতদল বাবুর নাম। তারপর অবশ্য শতদল বাবু আর মহুয়া দেবীর মুখ থেকে বাকি কথা বার করার কৃতিত্বটা অনেকটা পুলিশ মহলেরও!”

সেদিনই পুলিশ গ্রেফতার করলো শতদল বাবু আর মহুয়া দেবীকে। মুক্তি পেল শ্রীপর্ণা। সাথে উর্মি দেবী আর সায়ন্তন বাবুকেও কোনো মানসিক রোগের হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। বাড়ির বাগানের একটি ঝোঁপের ভেতর থেকে খুঁজে পাওয়া গেল গ্লাভসটাকেও। এরপর দেশের বিচার ব্যবস্থা উর্মি দেবীর মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে করা এই অপরাধকে কি চোখে দেখে, বা তাকে কি শাস্তি দেয়, সেদিকেই এখন চোখ থাকবে সকলের!

অরূপ বাবুর বাড়ি থেকে ফিরতি পথে টুসু গৈরিককে বলে উঠলো, “প্রেমে ব্যর্থতার মত সাধারণ বিষয়ও যে মানুষের কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনে, এই কেস তার প্রমান। উর্মি দেবী, সায়ন্তন বাবু আর অরূপ বাবুর সম্পর্ক সত্যিই ‘ঘাতক ত্রিকোণ'”
গৈরিক একটা সিগারেট ধরিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দিলো, “হুমম, তবে ঘাতক ত্রিকোণ কিন্তু একটা নয়… মহুয়া দেবী, সায়ন্তন বাবু আর উর্মি দেবীর সম্পর্কের ত্রিকোণটাও কিন্তু যথেষ্টই ঘাতক, বুঝলি টুসু!”
টুসু উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠলো, “সত্যিই গেরোদা, কিসের সাহায্যে যে তুমি এই জটিল কেসটার সমাধান করে উঠতে পারলে, সেই কথাই ভাবছি!”
গৈরিক সম্পূর্ণ ফেলুদার স্টাইলে সিগারেটে সুখটান দিয়ে, আঙুলে তুড়ি মেরে বলে উঠলো, “মগজাস্ত্র!”

(সমাপ্ত)

Loading

Leave A Comment